ঘূর্ণিঝড়: কীভাবে তৈরি হয়, কেন হয়, এবং কীভাবে সতর্ক থাকতে হবে

ঘূর্ণিঝড় একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা সাধারণত ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রপৃষ্ঠে সৃষ্ট নিম্নচাপের কারণে জন্ম নেয়। এই নিম্নচাপ কেন্দ্রে প্রচণ্ড ঘূর্ণি হাওয়া এবং মেঘ জমে সৃষ্টি করে এক ধরণের শক্তিশালী ঝড়, যা অনেক সময় উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে সক্ষম হয়।

ঘূর্ণিঝড় কীভাবে গঠিত হয়?

বিষুবীয় অঞ্চলের সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেশি থাকে। এই উচ্চ তাপমাত্রার ফলে সমুদ্র থেকে উষ্ণ ও আর্দ্র বাতাস উপরের দিকে উঠতে থাকে। এতে সমুদ্রপৃষ্ঠে একটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়। চারপাশের উচ্চচাপের বাতাস তখন এই নিম্নচাপ কেন্দ্রে ছুটে আসে। এই প্রবাহিত বাতাসও উষ্ণ হয়ে আবার উপরের দিকে উঠে মেঘ তৈরি করে এবং ধীরে ধীরে পাক খেতে শুরু করে। এভাবেই একটি ঘূর্ণিঝড়ের জন্ম হয়।

এই ঝড়গুলো যখন সমুদ্রের ওপরে থাকে, তখন সমুদ্রের গরম জল থেকেই এরা শক্তি সংগ্রহ করে। তবে একবার ভূমিতে আছড়ে পড়লে, জ্বালানি (উষ্ণ জলীয় বাষ্প) না থাকায় দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে ভূমিতে আঘাত করার আগেই ঘূর্ণিঝড় প্রচুর বৃষ্টি, বাতাস এবং জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি করতে পারে।

‘অশনি’ ঘূর্ণিঝড় ও সাম্প্রতিক সতর্কতা

২০২২ সালের মে মাসে বঙ্গোপসাগরে গঠিত ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’ শক্তি সঞ্চয় করে ওড়িশা ও অন্ধ্রপ্রদেশ উপকূলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এই ঝড় হঠাৎ গতিপথ পরিবর্তন করে বাংলাদেশের দিকেও আসতে পারে। ফলে ১১ মে থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা তৈরি হয়।

ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা এবং পায়রা সমুদ্রবন্দরে জারি করা হয় বিপদসংকেত। ৯ মে পর্যন্ত অশনি ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি অপরিবর্তিত ছিল এবং এটি দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করছিল।

ঘূর্ণিঝড় সতর্ক সংকেতের অর্থ

অনেকেই জানেন না যে, ঘূর্ণিঝড়ের সতর্ক সংকেত মানে কী। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর সাধারণত ১ থেকে ১১ পর্যন্ত সংকেত দেয়। প্রতিটির নিজস্ব অর্থ আছে:

  • ১ ও ২ নম্বর: দূরবর্তী সতর্কতা এবং হুঁশিয়ারি

  • ৩ ও ৪ নম্বর: স্থানীয় সতর্কতা ও হুঁশিয়ারি

  • ৫, ৬ ও ৭ নম্বর: বিপদসংকেত

  • ৮, ৯ ও ১০ নম্বর: মহাবিপদসংকেত

  • ১১ নম্বর: চরম ঝুঁকি, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা

এই সংকেত অনুযায়ী স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণকে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়, যেমন আশ্রয়কেন্দ্রে সরে যাওয়া, মাছ ধরার নৌকা নিরাপদ স্থানে রাখা, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা ইত্যাদি।

ঘূর্ণিঝড় কতটা ভয়ংকর হতে পারে?

ঘণ্টায় বাতাসের গতি যদি ৩৯ মাইল ছাড়িয়ে যায়, তখন তাকে ট্রপিকাল স্টর্ম বলা হয়। আর যদি তা ৭৪ মাইল বা তার বেশি হয়, তবে সেটিকে ট্রপিকাল সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড় হিসেবে ঘোষণা করা হয়। গতি এবং শক্তির ভিত্তিতে এই ঝড়গুলোকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়।

উপসংহার

বাংলাদেশের মত উপকূলবর্তী দেশে ঘূর্ণিঝড় একটি নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তাই এই ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় সতর্কতা, সচেতনতা এবং যথাযথ প্রস্তুতি অত্যন্ত জরুরি। প্রযুক্তির উন্নতির ফলে এখন ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস অনেক আগেই পাওয়া যায়, যা সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব করে।

এজন্য প্রত্যেক নাগরিকের উচিত ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত ও তার তাৎপর্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং প্রশাসনের নির্দেশনা মেনে চলা। এতে জীবন ও সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।