সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশীয় সিনেমার বাজারে এক অভাবনীয় পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। একদিকে আন্তর্জাতিক বক্স অফিসে বলিউডের বড় বাজেটের সিনেমাকে পেছনে ফেলে রেকর্ড গড়ছে পাকিস্তানি ছবি, অন্যদিকে ভারতের দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রিতে চলছে বাণিজ্যিক ও আর্টহাউস ঘরানার এক অভিনব নিরীক্ষা। প্রথাগত বলিউড তারকাদের একচ্ছত্র আধিপত্য যে কমছে, তার প্রমাণ মিলছে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বক্স অফিস পরিসংখ্যানে।
বিদেশের মাটিতে ‘দ্য লিজেন্ড অব মাওলা জাট’-এর দাপট
দীর্ঘদিন ধরেই প্রবাসী দর্শকদের কাছে বলিউডের সিনেমা মানেই ছিল উৎসবের আমেজ। কিন্তু এবারের চিত্রটা ভিন্ন। বলিউডের সুপারস্টার অক্ষয় কুমারের ‘রাম সেতু’ এবং অজয় দেবগন ও সিদ্ধার্থ মালহোত্রার ‘থ্যাংক গড’—দুটি বড় বাজেটের সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পরেও স্পটলাইট কেড়ে নিয়েছে পাকিস্তানের ছবি ‘দ্য লিজেন্ড অব মাওলা জাট’। গত ১৩ অক্টোবর মুক্তি পাওয়া এই সিনেমাটি দীপাবলির মৌসুমে মুক্তি পাওয়া বলিউড ছবিগুলোর সঙ্গে সমানে টক্কর দিচ্ছে। পাকিস্তানের দৈনিক ডনের তথ্যমতে, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে এই ছবিটি আয়ের দিক দিয়ে বলিউডকে পেছনে ফেলেছে। বলিউড হাঙ্গামার পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাজ্যে ৫৬টি হলে মুক্তির ১৩তম দিনে ‘দ্য লিজেন্ড অব মাওলা জাট’ আয় করেছে ৪৬ হাজার ৮২৫ মার্কিন ডলার। এর বিপরীতে ৫৩টি হলে চলা ‘থ্যাংক গড’ আয় করেছে ১৯ হাজার ৪৭২ ডলার এবং ৯৫টি হলে প্রদর্শিত ‘রাম সেতু’র আয় মাত্র ১৬ হাজার ৫৯৫ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের চিত্রও একই; সেখানে ৯০টি হল থেকে পাকিস্তানি ছবিটির আয় ৫৬ হাজার ৫৬৮ ডলার, যেখানে অনেক বেশি হল (৩৫৪টি) পেয়েও ‘রাম সেতু’ আয় করেছে ৪৮ হাজার ৩৩০ ডলার।
১০০ কোটির মাইলফলক ও পুরনো গল্পের নতুন রূপ
বক্স অফিসের এই সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছেন দুই পরিচিত মুখ—ফাওয়াদ খান ও মাহিরা খান, যারা দুজনই একসময় বলিউডে দাপটের সঙ্গে কাজ করেছেন। ‘রইস’ সিনেমায় শাহরুখ খানের বিপরীতে মাহিরা এবং ‘খুবসুরত’ ছবিতে সোনম কাপুরের বিপরীতে ফাওয়াদের রসায়ন দর্শকদের মনে দাগ কেটেছিল। ছবির নির্বাহী প্রযোজক আম্মারা হিকমত জানিয়েছেন, মুক্তির মাত্র ১০ দিনের মধ্যেই ছবিটি বিশ্বজুড়ে ১০০ কোটি রুপি (পাকিস্তানি মুদ্রা) আয়ের মাইলফলক স্পর্শ করেছে। এর আগে ২০১৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘জওয়ানি ফির নেহি আনি ২’ ছবিটি ৭০ কোটি রুপি আয় করে শীর্ষে ছিল। মূলত ১৯৭৮ সালের পাঞ্জাবি ক্ল্যাসিক্যাল ‘মাওলা জাট’-এর আধুনিক সংস্করণ এই ছবিটি, যেখানে এক অত্যাচারিত যোদ্ধার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ ও ন্যায়বিচারের গল্প তুলে ধরা হয়েছে।
সীমানার ওপারে ভিন্নধর্মী সিনেমার খোঁজ
যখন আন্তর্জাতিক বাজারে পাকিস্তানি সিনেমা বাণিজ্যিক সফলতার নতুন নজির গড়ছে, ঠিক তখনই ভারতের দক্ষিণী সিনেমার আঙিনায় চলছে ভিন্ন এক গল্পের বুনন। তেলুগু তারকা রানা দাগ্গুবতী এবং মালয়ালম হার্টথ্রব দুলকার সালমান হাত মিলিয়েছেন ‘কান্তা’ নামের একটি পিরিয়ড থ্রিলার সিনেমার জন্য। তামিল ও তেলুগু ভাষায় মুক্তি পাওয়া এই ছবিটি বিশ্বজুড়ে প্রায় ২৭ কোটি রুপি আয় করেছে এবং তামিলনাড়ুতে হিট তকমা পেয়েছে। ১৯৫০ সালের মাদ্রাজের পটভূমিতে নির্মিত এই সিনেমাটিকে রানা দাগ্গুবতী আখ্যায়িত করেছেন ‘ইন্ডিও এক্সপেরিমেন্ট’ হিসেবে। আগাথা ক্রিস্টির রহস্য উপন্যাসের আদলে তৈরি এই গল্পে দুলকার অভিনয় করেছেন সুপারস্টার টি কে মহাদেবনের চরিত্রে এবং রানা রয়েছেন পুলিশ অফিসার ফিনিক্সের ভূমিকায়।
বন্ধুত্ব ও প্রযোজনার চ্যালেঞ্জ
রানা ও দুলকারের বন্ধুত্ব সেই নবম শ্রেণি থেকে। তবে ‘কান্তা’ সিনেমায় তাঁরা কেবল অভিনেতা নন, সহ-প্রযোজক হিসেবেও কাজ করেছেন। রানার স্পিরিট মিডিয়া এবং দুলকারের ওয়েফারের ফিল্মস—এই দুই প্রতিষ্ঠানের যৌথ প্রয়াস এই ছবি। রানা দাগ্গুবতীর মতে, তেলুগু দর্শকরা সাধারণত যে ধরনের বাণিজ্যিক ছবি দেখতে অভ্যস্ত, তার চেয়ে ‘কান্তা’ অনেকটাই আলাদা এবং শৈল্পিক। তবে তামিল দর্শকরা এটিকে সাদরে গ্রহণ করেছেন। পরিচালক সেলভামনি সেলভারাজ, যিনি নেটফ্লিক্সের ‘দ্য হান্ট ফর বীরাপ্পান’ তথ্যচিত্রের জন্য পরিচিত, তাঁর এটিই প্রথম ফিচার ফিল্ম। রানার কথায়, একজন নতুন নির্মাতাই কেবল নতুন ধরনের গল্প বলতে পারেন। স্প্যানিশ সিনেমাটোগ্রাফার দানি সানচেজ লোপেজ এবং পরিচালক সেলভার মুন্সিয়ানায় সিনেমাটিতে মেটা-ফিল্ম ঘরানার এক দারুণ আবহ তৈরি হয়েছে।
মতপার্থক্য যখন সাফল্যের চাবিকাঠি
শুটিংয়ের সময় দুই বন্ধুর মধ্যে মতবিরোধ যে হয়নি, তা নয়। তবে রানা জানিয়েছেন, সেসব তর্ক ছিল সিনেমার ভালোর জন্যই। রানার চিন্তাধারা যেখানে পুরোপুরি বাণিজ্যিক, দুলকারের পছন্দ সেখানে কিছুটা ভিন্ন ধাঁচের। দুজনের এই বিপরীতমুখী চিন্তাভাবনা এবং মালয়ালম সিনেমার ন্যারেটিভের সঙ্গে তেলুগু সিনেমার বিশালতার মিশ্রণেই তৈরি হয়েছে ‘কান্তা’। রানার এক বন্ধু সিনেমাটি দেখার পর মন্তব্য করেছিলেন, এই ছবির মাধ্যমে স্বাধীন চলচ্চিত্র এবং বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র যেন একে অপরের সঙ্গে হাত মেলাল। দক্ষিণ এশিয়ার সিনেমার এই বাঁক বদল—হোক তা পাকিস্তানের মাওলা জাট দিয়ে বিশ্ব জয় কিংবা ভারতের কান্তা দিয়ে নতুন গল্পের নিরীক্ষা—প্রমাণ করছে যে দর্শক এখন তারকাখ্যাতির চেয়ে ভালো কন্টেন্টকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন।






